বিশেষ প্রতিবেদকঃ পৃথিবীর আদিযুগে মানুষ যখন উন্নত ও সুসভ্য হয়নি, তখন বলতে গেলে প্রায় সব দেশের চিকিৎসাপদ্ধতি একই ধরনের ছিল। ক্রমান্বয়ে সময় ও চাহিদার তাগিদে অসুখ হলে মানুষ নির্ভর করেছে প্রকৃতির ওপর। ধীরে ধীরে মানুষের অভিজ্ঞতা ও গবেষণার আলোকে আবিষ্কার হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, গাছ-গাছড়ার ব্যবহার, পথ্য ও খাবার। মানুষের চাওয়া পাওয়া যেমন শেষ নেই, তেমনি শেষ নেই জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে অপরিসীম গবেষণা ও আবিষ্কারের। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি সব কিছু সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন সাধনা।
ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞান পূর্বের মনীষীদের রেখে যাওয়া নিরলস গবেষণার ফসল। তখনকার সময়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা স্থানীয় গাছ-গাছড়া নিয়ে বাস্তব পরীক্ষা নিরীক্ষার আলোকে চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্যাবলি সংগ্রহ করে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে সামর্থ্য হন। সুতরাং প্রাচীন কাল থেকে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্থানীয় গাছ-গাছড়া বেশি ব্যবহৃত হয় বিধায়, এ চিকিৎসাপদ্ধতিদ্বয় আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমান গতিশীল বিশ্বে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের দিনেও ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ওষুধের প্রয়োজনীয়তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) সুপারিশ অনুযায়ী সবার জন্য স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সার্বজনীন জনপ্রিয় করে তুলতে জোর সুপারিশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শক্রমে বর্তমান সরকার ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির বিকাশ সাধনে বহুমুখী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সরকারের এ ধরনের উদ্যোগকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে পাস করা একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা কৌশলতার পাশাপাশি রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত ভেষজ উদ্ভিদের পরিচিতি, কার্যকারিতা, মিযাজ (Temperament) সেবনমাত্রা, ব্যবহার্য অংশ এবং ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে সমান দক্ষতা অর্জন করতে হয়। স্নাতক কিংবা ডিপ্লোমা কোর্সে ৪-৫ বছরে প্রায় ২০-২৫টি বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করতে হয়। কলেজের পাঠ্য তালিকায় মূল বিষয় গুলোয় বিভিন্ন রোগ ও ভেষজ উপাদানের বর্ণনার সাথে হাজার হাজার ওষুধের ফর্মুলা সম্পর্কে আলোচনা ও ওষুধ তৈরি পদ্ধতি হাতে কলমে শিক্ষা দেয়া হয়।
তাই আবহমান কাল থেকে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা রোগীদের নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ চিকিৎসক নিজেই ওষুধ তৈরি করে দেয়ার নীতি অনুসরণ করে আসছেন। চিকিৎসক একজন রোগী তার রোগের ইতিহাস, কারণ, লক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা প্রভৃতি চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কিংবা প্রয়োজনে আধুনিক পরীক্ষা- নিরীক্ষার আলোকে সঠিক রোগ নির্ণয় পূর্বকব্যবস্থাপত্র দেন। ব্যবস্থাপত্রে- জোশান্দা (Decoction) খেসান্দা (Infusion) মুসহেল, মুনজিজ, তাজা ভেষজ উপাদানের নির্যাস, আরক, ফল ফলাদির রস, গুলকন্দ, বটিকা, (Pill) সফুফ বা চূর্ণ জাতীয় ওষুধ প্রভৃতি দিয়ে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ওষুধ গুলোকে কোনো ভাবেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন করা সম্ভব নয়। এগুলো রোগীর অবস্থার ওপর নির্ভর করে তাৎক্ষণিক ভাবে তৈরি করে দিতে হয়।
সুতরাং অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থারম মতো একই মাপকাঠিতে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিচার-বিশ্লেষণ করা হলে প্রকৃত চিকিৎসা সেবা থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবে। ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। গবেষণার দ্বার হবে রুদ্ধ। বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে হাজার হাজার নির্ভরযোগ্য ফর্মুলা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ছাত্র-ছাত্রীর অভাবে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ গুলোর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। প্রাচীনকাল থেকে ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি মানবতার কল্যাণে যে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি, দর্শন ও স্বকীয়তা নিয়ে পৃথিবীর বুকে টিকে রয়েছে। সে চলমান ধারাকে আরও সুন্দর ও গতিশীল করাই হবে নীতি-নির্ধারকদের আসল কাজ। চলমান বৈজ্ঞানিক দর্শন ও আদর্শকে বাদ দিয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত সামান্য সংখ্যক ওষুধ দিয়ে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক বিজ্ঞানকে রক্ষা করা যাবে না। এর জন্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি থাকতে হবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদিত ওষুধের মান (Quality) নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যে কোনো চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে হলে বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে মানসম্পন্ন ওষুধের (Quality Medicine) প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ইউনানী-আয়ুর্বেদিক এবং হারবাল মিলিয়ে প্রায় ৫০০ প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদন লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১০-১৫টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান একই জাতের সামান্য সংখ্যক ওষুধ উৎপাদন করে যাচ্ছে।
অথচ অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে হাজার হাজার রকমের ওষুধ উৎপাদন করা সত্ত্বেও সব রোগের চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন। দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত আধুনিক মানের ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না, এমন ধরনের কোটি কোটি টাকার ওষুধ প্রতি বছর আমদানি করা হয়। ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যারা নীতি-নির্ধারক তারা এগুলোকে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সরকারকে সহযোগিতা করে ঐতিহ্যবাহী ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিন। যাতে আগামী প্রজন্মের মানুষ এ চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রকৃত সুফল পেতে পারে।
পৃথিবীর শুরু থেকে মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে গবেষণা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় গাছ-গাছড়া দিয়ে প্রথাগত লোকজ চিকিৎসা করে আসছেন। যেমন কোষ্ঠ-কাঠিন্য হলে ইসবগুল ভুসির শরবত সেবন, কাশি হলে তুলসী পাতা বা বাসক পাতার রস মধুসহ সেবন, সাধারণ দুর্বলতায় ডালিমের রস সেবন, বদহজম হলে আদা কিংবা পুদিনা পাতার রস সেবন ইত্যাদি। এসব অসংখ্য রোগব্যাধি স্থানীয় উপকরণ দিয়ে কার্যকর চিকিৎসা করা যায় এগুলো কারো অজানা নয়। সুতরাং পৃথিবী যত দিন টিকে থাকবে তত দিন পর্যন্ত লোকজ চিকিৎসাব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে। এতে কারো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই। অথচ ওষুধ আইন ২০১৭ খসড়ার ১৯ নম্বর ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে ‘কোনো চিকিৎসক তাহার ব্যবস্থাপত্রে কোনো রোগীকে আইনের অধীন নিবন্ধিত নয় এরূপ কোনো ওষুধ ব্যবহারের জন্য পরামর্শ /ব্যবস্থাপত্র প্রদান করবেন না।’ তাহলে হাজার হাজার বছরের প্রথাগত লোকজ চিকিৎসা কি একবারেই বাদ হয়ে যাবে? সুতরাং ওষুধ আইন ২০১৭ এর অসংখ্য ধারা ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংশোধন কিংবা সংযোজন করা দরকার। নতুবা সাধারণ মানুষ প্রকৃত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হবে। ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাব্যবস্থা বিকাশ সাধনে বাধাগ্রস্ত হবে।
Excellent news . Not present it also effectively for comeing days. Let’s go to nature. Nature’s can save all affected areas.